রাজশাহী সরকারি সিটি কলেজের জন্ম ইতিহাস

তথাকথিত পাকিস্তান রাষ্ট্রের স্বাধীনতালাভের কাল থেকে এ অঞ্চলের শিক্ষালাভের ক্ষেত্রে পর্বতপ্রমাণ বাধার সম্মুখীন হয়েছে জনসংখ্যা অনুপাতে পর্যাপ্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অভাবের কারণেই। একটি ব্যাপক সংখ্যক শিক্ষিত হিন্দু ব্যক্তিত্বের তদানীমত্মন পূর্বপাকিস্তান থেকে ভারতে অভিবাসন বিষয়টিকে আরো স্পষ্টতর করে তুলেছিল। ফলশ্রুতিতে তরুণ সম্প্রদায় প্রচন্ড আর্থিক সংকট এবং পঙ্গু অর্থনীতির কারণে একটি দুর্দশাগ্রসত্ম অবস্থার মধ্য দিয়ে যাচ্ছিল এবং ভাবতে বাধ্য হয়েছিল যে, তাদের উচ্চ শিক্ষালাভের আশা-আকাঙ্ক্ষা অকালেই ঝরে যাবে এবং তাদের উজ্জ্বল ভবিষ্যতকে উত্তরণের উচ্চতর ধাপে প্রতিষ্ঠার প্রয়াস আগামী সকল সময়ের জন্য চিরবিষণ্ণই থেকে যাবে। এ সকল বাধাবিপত্তির মাঝেও তাদেরকে চাকুরীর খোঁজে এদিক সেদিক ঘুরে বেড়াতে হবে এবং কেউ কেউ ভাগ্যের সুপরিবর্তনে কোন চাকুরীর খোঁজ না পেয়ে প্রত্যমত্ম গ্রামের নিভৃত কোণে হতাশার ঝিমুনিতে দিনাতিপাত করবে।

এমতাবস্থার মধ্যে একমাত্র রাজশাহী সরকারি কলেজ ও একটি বেসরকারী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আদিনা ফজলুল হক কলেজ রাজশাহী জেলার অতি স্বল্পসংখ্যক তরুণদের শিক্ষালাভের
খু-উ-ব সীমিত পরিসর ও সুযোগ সুবিধা যোগাতে পারত। কিছুসংখ্যক মুখ সোনার চামচ নিয়ে জন্ম নেওয়া তরুণ শিক্ষার এ সুবিধাটুকু গ্রহণ করতে পারত অথচ একটি সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠী যারা তাদের জীবিকার জন্য কৃষির উপর নির্ভরশীল এবং দারিদ্র্যপীড়িত মধ্যবিত্ত শ্রেণী থেকে আগত তাদের এমন প্রতিষ্ঠানে শিক্ষাগ্রহণের সুযোগ কমই ছিল বলা চলে।

এমত হতাশা ও ভীতির মাঝেও রাজশাহী শহরের বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষের মনে গভীরভাবে অনুভূত হয়েছিল একটি কলেজ প্রতিষ্ঠার অপরিহার্যতা এবং তজ্জন্য দাবীও গতি লাভ করেছিল ক্রমাগত। দেশে সভ্যতা ও সংস্কৃতির অগ্রগতির সাথে সাথে সরকারের দারিদ্র্য মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন বিভিন্ন দপ্তরে কর্মরত স্বল্পবেতনভুকদের জাগ্রত জনগোষ্ঠীর একাংশের মনে এবং সেই সাথে বেসরকারী প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের মনেও একটি চিমত্মা দেখা দিল তারা কিভাবে তাদের শিক্ষাগত যোগ্যতা বাড়াতে পারে এবং পেশাগত দক্ষতা ও পারিপার্শ্বিকতার উন্নয়ন ঘটাতে পারে। এভাবে তাদের সমন্বিত অভিমতসমূহ শহরের গণ্যমান্য নাগরিক ও গুরুজনদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়তে থাকে যাঁরা তাদের ন্যায়সঙ্গত কারণগুলো জনগণ এবং প্রশাসনিক প্রধানদের কাছে উপস্থাপন করে। এরই ফলশ্রুতিতে সরকারী কর্তৃপক্ষ এবং জেলা প্রশাসন প্রধান প্রসত্মাবনার সাথে পর্যাপ্ত সহমর্মিতা প্রকাশ করে এবং এই প্রকল্পের বাসত্মবায়নের জন্য পর্যাপ্ত তহবিল সংস্থানে ব্যাপকভাবে সহায়তা দান করেন। জনগণ এবং প্রশাসনিক কর্তৃপক্ষের এমত প্রয়াসের ফলাফলেই রাজশাহী সিটি কলেজের নৈশবিভাগ ১৯৫৮ সালের জুলাই মাসে প্রতিষ্ঠিত হয়।

কলেজের যাত্রা শুরুতে এর কোন নিজস্ব ভবন ছিল না। ক্লাসসমূহ নেয়া হত লোকনাথ হাইস্কুল চত্বরে। ১৯৫৮ সালে ১৮,০০০/- টাকায় শহরের কেন্দ্রস্থলে ০.৫০ একর জমি ক্রয় করা হয়। একজন প্রখ্যাত পন্ডিত রাজশাহী সরকারী কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ মরহুম মোঃ আবদুল করিম অত্র কলেজের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ হন। তার দুঃখজনক বিয়োগামেত্মর পর কলেজটি পরিচালনার দায়িত্ব পড়ে প্রত্নতত্ত্বের অবসরপ্রাপ্ত পরিচালক রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন কোষাধ্যক্ষ জনাব শামসুদ্দিন আহমেদের উপর।

১৯৫৮ সালে ১৪০ জন ছাত্র নিয়ে কলেজটি যাত্রা শুরু করে এবং ছাত্ররা নৈশ বিভাগে ক্লাস চালিয়ে যাওয়ার মত সাহস ও শৃঙ্খলাবোধ দেখায় এবং পরবর্তীতে সামনের বছরগুলোতে ছাত্রসংখ্যা বৃদ্ধি পেতে পেতে ১৯৬৯ সালে এসে মোট ছাত্রসংখ্যা দাঁড়ায় ৩৫০০তে। প্রাথমিক পর্যায়ে কলেজের শিক্ষক কাঠামো বলতে একজন অবৈতনিক অধ্যক্ষ, চারজন পূর্ণকালীন অধ্যাপক, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দুইজন খন্ডকালীন অধ্যাপক এবং রাজশাহী কলেজ থেকে ৩ জন খন্ডকালীন এবং স্থানীয় বার থেকে একজন খন্ডকালীন শিক্ষক সমন্বয়ে গঠিত ছিল।

কলেজটি দিনে দিনে সকলক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠা লাভ করছিল। কলেজটির অতি প্রয়োজনীয় একটি বিষয় ছিল কলেজের নিজস্ব গ্রন্থাগার। ১৯৯৯ সালে ৩০৭৫/- টাকা দিয়ে ৪০০ খানা বই ক্রয়ের মাধ্যমে কলেজের গ্রন্থাগার প্রতিষ্ঠা করা হয়।

রাজশাহী সরকারি সিটি কলেজের জীবনের স্মরণীয় বৎসরটি ১৯৫০-এর সাল থেকে শুরু। ১৯৬০-এর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় কলেজটিকে ৩ বৎসরের জন্য অধিভুক্তির আদেশ প্রদান করে। উল্লেখ করার মত বিষয় যে, ১৯৬৩ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় কলেজটিতে নৈশ এবং দিবাভাগে উচ্চ মাধ্যমিক খোলার অধিভুক্তির মঞ্জুরি প্রদান দ্বারা ব্যাপক সহানুভূতি প্রদর্শন করে। ১৯৬৮ সালে উচ্চ মাধ্যমিক শাখায় সামাজিক বিজ্ঞান পাঠ্যক্রম এবং ১৯৭৩ সালে বাংলায় সম্মান শ্রেণী খোলা হয়। এভাবেই এটিকে একটি সম্মান শিক্ষার মর্যাদা ও মান-এ দাঁড় করানো হয়।
কলেজের উন্নয়নের কথা বললে বলতেই হয় যে কলেজ চত্বরের দক্ষিণ পাশে ১,০০,০০০/- টাকা ব্যয়ে একটি দ্বিতল ভবন করা হয়। সে সময়ের জেলা প্রশাসক এবং কলেজ গভর্নিং বডির চেয়ারম্যান জনাব পি.এ. নাজির কলেজটির উন্নয়নে তাঁর সাহায্যের হাত ব্যাপকভাবে প্রসারিত করেন। কলেজ সংলগ্ন এক একর জমি ১৯৬৭ সালে অধিগ্রহণ করা হয়। তদানীমত্মন পূ্র্ব পাকিসত্মান সরকার কর্তৃক মঞ্জুরিকৃত ৩,৫০,০০০/- টাকায় কলেজের পশ্চিম ব্লকটি নির্মাণ করা হয়। ১৯৭৬ সালে রাজশাহী উন্নয়ন বোর্ড কলেজটির উন্নয়নে ১,৫০,০০০/- টাকা মঞ্জুরি দেন। বাংলাদেশের অভ্যুদ্বয়ের পরপরই সরকার কলেজটিকে উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় নিয়ে কলেজের দক্ষিণ ব্লক নির্মাণের জন্য ৫ লক্ষ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়।

মোঃ শামসুদ্দিন আহমেদ, প্রখ্যাত পন্ডিত, কলেজের অবৈতনিক অধ্যক্ষ হিসেবে ১৯৬৩ সাল পর্যমত্ম কাজ করেন। তারপর উপাধ্যক্ষ এস. এম. আবদুল লতিফ ১৯৭৪ সালের ফেব্রুয়ারী পর্যন্ত অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭৭ সাল থেকে এপ্রিল, ১৯৮০ সাল পর্যন্ত জনাব মোঃ আবদুল্লাহ কলেজটির অধ্যক্ষ হিসেবে নিয়োজিত ছিলেন। ১৯৮২ সালে কলেজ জাতীয়করণের পর জনাব মোঃ বেলায়েত আলী, নিউ গভ: ডিগ্রী কলেজে বদলী হলে জনাব আফসারুজ্জামানসহ প্রমুখজন অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করেন। এরই মধ্যে কলেজটির আর একটি নয়া ভবন নির্মিত হয়। এই কলেজে উত্তরবঙ্গের সর্বোচ্চ সংখ্যক ছাত্র-ছাত্রী উচ্চ মাধ্যমিক শ্রেণীতে পড়াশোনা করে। ভাড়া বাড়ীতে কলেজের একটি হোস্টেল থাকলেও তদস্থলে বর্তমানে নতুন হোস্টেল ভবন নির্মিত হয়েছে। কলেজের লাইব্রেরীতে সম্মান শ্রেণীসহ প্রচুর মূল্যবান টেক্সট এবং অন্যান্য বই দ্বারা সমৃদ্ধ করা হয়েছে। লাইব্রেরীর স্বতন্ত্র ভবনও রয়েছে। এছাড়াও পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন, প্রাণিবিজ্ঞান, উদ্ভিদবিজ্ঞান, মনোবিজ্ঞান এবং কম্পিউটার শিক্ষা বিভাগের স্বয়ং সম্পূর্ণ পৃথক পৃথক ল্যাবরেটরী রয়েছে। বহুদিন থেকে গৃহীত বিভিন্ন সংস্কার কার্যক্রম পরিচালনার মধ্য দিয়ে কলেজের বর্তমান সুষ্ঠু সুন্দর ও সর্বাঙ্গ সুন্দর শিক্ষা কার্যক্রমে উন্নীত হয়েছে।